এমপক্স বা মাঙ্কিপক্স ! লক্ষণ ও উপসর্গ ! Monky Pox
এমপক্স বা মাঙ্কিপক্স ! লক্ষণ ও উপসর্গ...
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের নাম এমপক্স বা মাঙ্কিপক্স। করোনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি মহামারীর আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি ভাইরাসটির সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। আমাদের দেশেও সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আগমনী চ্যানেলে সার্বক্ষণিক একটি চিকিৎসক দল নিয়োজিত রয়েছে।
এমপক্স কী: এমপক্স হলো প্রাণীবাহিত ভাইরাসজনিত সংক্রামক ব্যাধি। ১৯৫৮ সালে কঙ্গোয় বানরের দেহে এ ভাইরাস প্রথমবার শনাক্ত হয়, তাই এমন নামকরণ। তবে শুধু বানর নয়, ভাইরাসটি ছড়াতে পারে ইঁদুর, বন্য কুকুর, কাঠবিড়ালি ও খরগোশের শরীর থেকেও। তীব্র জ্বরের মাধ্যমে শরীরে এ ভাইরাসের উপস্থিতি প্রকাশ পেতে শুরু করে। তীব্র ছোঁয়াচে হওয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির দ্বারা অন্যদের মধ্যেও এ ভাইরাস দ্রুত সংক্রমিত হয়।
এমপক্সের লক্ষণ ও উপসর্গ: ভাইরাস সংক্রমণের পর সাধারণত ৩ থেকে ১৭ দিনের মধ্যেই লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে। লক্ষণগুলো হলো—
• জ্বর ও মাথাব্যথা
• ত্বকে পানিভর্তি ফোসকা
• ফোসকায় ব্যথা ও চুলকানি
• মাংসপেশিতে ব্যথা
• পিঠে ব্যথা
• লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া
• গলাব্যথা ও কাশি
• দুর্বলতা
এগুলো সাধারণত দুই-চার সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। তবে যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভালো নয়, তাদের ক্ষেত্রে কিছুটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। এ সময় ওপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
যেভাবে ছড়ায়
• আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে। এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমেও এ ভাইরাস ছড়াতে পারে।
• সঙ্গী এমপক্সে আক্রান্ত হলে, যৌনমিলনের মাধ্যমে অন্যজন সংক্রমিত হতে পারে।
• সংক্রমিত ব্যক্তির ব্যবহৃত ইনজেকশনের সুই অন্য কেউ ব্যবহার করলে।
• গর্ভবর্তী মা এতে আক্রান্ত হলে, গর্ভের সন্তান সংক্রমিত হতে পারে।
• এমপক্সে আক্রান্ত বন্যপ্রাণীর মাংস ও তেল কম আঁচে রান্না করে খেলে।
কারা বেশি ঝুঁকিতে
• নবজাতক শিশু
• গর্ভবতী নারী
• দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি। যেমন কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও এইডস রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঝুঁকি বেশি।
প্রতিরোধে করণীয়
• আক্রান্ত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে।
• নিকটজনের কেউ আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সাবান, জীবাণুনাশক বা ডিটারজেন্ট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিন।
• হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন।
• বাইরে মাস্ক পরিধান করুন এবং ঘরে ফিরেই ভালো করে হাত ধুয়ে ফেলুন।
• ঘরের বাইরে থাকাকালীন ঘন ঘন নাকে-মুখে হাত দেয়ার অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করুন।
• স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তিরা মাস্ক ও গ্লাভস ব্যবহার করুন।
• এমপক্সের যেকোনো লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
এখনো এমপক্সের কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। তবে চিকিৎসক এর উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন। এর সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও সঠিক পরিচর্যা পেলে রোগী দ্রুত সেরে ওঠে।
লেখক: অধ্যাপক ডা. সমীরণ কুমার সাহা
সিনিয়র কনসালট্যান্ট
মেডিসিন বিভাগ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল
More about Mpox
ভাইরাসের ধরন: এমপক্স ভাইরাস দুটি প্রধান ক্লেডে বিভক্ত। ক্লেড ১ ও ক্লেড ২। ক্লেড ১ সাধারণত মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোয় পাওয়া যায় এবং এর মৃত্যুহার তুলনামূলক বেশি। ক্লেড ২ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোয় দেখা যায় এবং এটি দ্রুত ছড়ায়, তবে এর মৃত্যুহার কম। ২০২২ সালে ক্লেড ২বি দ্বারা একটি বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব ঘটে, যার মধ্যে ভারতে ৩০ জন রোগী শনাক্ত হয়। বর্তমানে আফ্রিকায় ক্লেড ১বি-এর প্রাদুর্ভাব চলছে, কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারতে এখন পর্যন্ত কোনো সুনিশ্চিত বা সন্দেহজনক ঘটনা পাওয়া যায়নি।
ঝুঁকি ও বিস্তার : আফ্রিকায় এমপক্সে আক্রান্তদের মধ্যে বেশির ভাগই ১৫ বছরের নিচে হলেও এটি সবার জন্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে। আফ্রিকার বাইরের দেশে, বিশেষত সমকামী পুরুষদের মধ্যে এ ভাইরাসের সংক্রমণ বেশি দেখা যাচ্ছে। যদিও অন্যান্য জনগোষ্ঠী যেমন স্বাস্থ্যকর্মী, কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের মধ্যেও সংক্রমণ ঘটতে পারে। এমপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে এলে, সংক্রমিত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক, তাদের বিছানায় ঘুমালে বা একই কাপড় ব্যবহারে সংক্রমণ ঘটতে পারে। মুখ থেকে নিঃসৃত লালার মাধ্যমেও সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে।
চিকিৎসা
ত্বকের ফুসকুড়ি বা ফোসকা থেকে নমুনা নিয়ে পিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে এমপক্স নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশ সরকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ল্যাবকে এ পরীক্ষার জন্য নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে এমপক্সের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। তাই উপসর্গ ও লক্ষণের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।
প্রতিরোধ ও সুরক্ষা
এমপক্সের সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য কয়েকটি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত:
• মৃত প্রাণীর সংস্পর্শ এড়ানো
• সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শ পরিহার
• বিছানা বা পরিধেয় কাপড় শেয়ার না করা
• নিরাপদ যৌন আচরণ পালন করা
জনসচেতনতা: এমপক্সের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মধ্যে এমপক্সের লক্ষণ, ঝুঁকি ও প্রতিরোধের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্য বিভাগকে কাজ করতে হবে। জনসাধারণকে নিয়মিত হ্যান্ডওয়াশিং, সঠিক শ্বাসনালি সুরক্ষা বা মাস্ক পরিধান এবং সঠিক স্বাস্থ্যবিধির মাধ্যমে ভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ করতে উৎসাহিত করতে হবে। স্কুল, কলেজ, অফিস ও অন্যান্য সামাজিক স্থানে সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ দ্রুত ওই রোগের লক্ষণ সম্পর্কে জানতে পারে, রোগটি চিহ্নিত করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।
আইডিএইচ, মহাখালীর ভূমিকা: সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল (আইডিএইচ) মহাখালী ঢাকা শহরের একটি প্রধান স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে এমপক্সের ঝুঁকি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। হাসপাতালটি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসাসংক্রান্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করছে। এরই মধ্যে এ হাসপাতালে সন্দেহজনক এমপক্স রোগীদের চিকিৎসার জন্য একটি আইসিইউ সুবিধাসহ মোট ১০ বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুত রয়েছে এবং আইইডিসিআরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা রোগীর সঠিক চিকিৎসা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও আপডেট পাচ্ছেন। তবে যতক্ষণ না কার্যকর একটি টিকা পাওয়া যায়, ততক্ষণ আমাদের সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই প্রধান সুরক্ষা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন