ক্ষুদ্রতম জীবাণু, বৃহত্তম মাথা ব্যথা। নতুন মহামারির যুগে স্বাগত। অজানা জীবাণু থেকে মহামারি ঠেকাতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। করোনা ভাইরাস।।

ক্ষুদ্রতম জীবাণু, বৃহত্তম মাথা ব্যথা ...নতুন মহামারির যুগে স্বাগত... পৃথিবীতে জয়পতাকা উড়িয়ে মানুষের চোখ এখন মহাবিশ্বে। তাও তো অনেক দিন হলো। জয় করার স্পৃহা মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। এই জয় করতে গিয়ে সে মাঝেমধ্যেই ভুলে যাচ্ছে, তার ‘একিলিস হিলের’ কথা। সে ভুলে যাচ্ছে, রাজ্য জয় মানে সবকিছু জয় নয়। জয়পতাকা শুধু একটা নিশানই কেবল, যা রক্ষার জন্য সদাসতর্ক থাকার বাধ্যবাধকতাও তৈরি হয়। আর এই ভুলে যাওয়ার পথ ধরেই নতুন নতুন দুর্যোগ নেমে আসে মানুষের পৃথিবীতে। কোনোটি রোগের রূপ নিয়ে, কোনোটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রূপ নিয়ে। পৃথিবীর মানুষ এখন এমনই এক দুর্যোগের সামনে দাঁড়িয়ে। বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের কথা। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস এরই মধ্যে ৫০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইরানের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। ইতালির পর ফ্রান্সেও বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত ৬০ জন আক্রান্তকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে একজন রয়েছে, যার কোনো করোনাভাইরাস আক্রান্ত এলাকা বা ব্যক্তির সংস্পর্শে যাওয়ার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ ভাইরাসটি যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিটিতেই বিচরণ করছে। এ পরিস্থিতিতে নিজেদের প্রস্তুতি পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে দেশটির বিশেষজ্ঞ মহল। একই অবস্থা জার্মানিতেও। সৌদি আরব ওমরাহসহ সব ধরনের পর্যটন বন্ধ করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা এরই মধ্যে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। এই যে পরিস্থিতি, এর শুরুটা কিন্তু অসতর্কতা থেকেই। আরও ভালো করে বললে, আশু সংকটকে অবহেলা করাই এর ভিতটি তৈরি করেছে। ২০১৮ সালে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক সভায় গবেষণা সংস্থা আরঅ্যান্ডডি ব্লুপ্রিন্টের বিশেষজ্ঞ দল প্রথম ‘ডিজিজ এক্স’ নাম দিয়ে পরবর্তী মহামারি সম্পর্কে সতর্ক করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, পরবর্তী মহামারিটি কী থেকে উদ্ভূত হবে, তা জানা নেই। কিন্তু এর আশঙ্কা প্রবল। অজানা সেই জীবাণুরই নাম তাঁরা দিয়েছিলেন, ‘ডিজিজ এক্স’। তাঁরা বলেছিলেন, চেনা কোনো জীবাণু থেকে পরবর্তী মহামারি হওয়ার আশঙ্কা কম। আর তেমন হলেও চেনা শত্রুর বিষয়ে মানুষের মোটামুটি প্রস্তুতি থাকে। মুশকিল হচ্ছে অজানা জীবাণু নিয়ে। সে সময় গবেষকেরা এমনকি এও বলেছিলেন যে, এই ডিজিজ এক্স কোনো প্রাণী দেহ থেকে আসা ভাইরাস থেকেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাঁরা বলেছিলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিস্তৃত হওয়ার কারণে আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রাণীর সংস্পর্শে আসছে মানুষ। ফলে বিভিন্ন প্রাণীর শরীরে থাকা জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যাচ্ছে। মানুষ এখন এক নতুন মহামারির যুগের সামনে দাঁড়িয়ে। এটি মোকাবিলা করতে হলে সমন্বিতভাবে বৈশ্বিক একটি উদ্যোগ নিতে হবে। শুধু সে সময়ই নয়, বিভিন্ন সময়ই বিজ্ঞানীরা অজানা রোগের বিষয়ে মানুষকে সতর্ক করে আসছিলেন। তাঁরা বারবার বলেছেন, অজানা অচেনা জীবাণু সৃষ্ট রোগ নীরবে ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মানুষের প্রস্তুতি এখনো যথেষ্ট নয়। তাঁদের প্রস্তাব ছিল, কোনো রোগের সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর ব্যবস্থা গ্রহণের বদলে, সম্ভাব্য ক্ষতিকর জীবাণু প্রতিরোধ ও তা থেকে সৃষ্টি হতে পারে এমন সম্ভাব্য রোগের নিরাময়ের বিষয়ে আগে থেকেই গবেষণা করা উচিত। না, হালের এই করোনাভাইরাস হয়তো আগেকার দিনের কলেরা, গুটিবসন্ত, প্লেগের মতো অতটা প্রাণঘাতী নয়। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া মানেই মৃত্যু নয়। কিন্তু এ তো সত্য যে, এটি মৌসুমি ফ্লুয়ের মতো দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং এতে মৃত্যুর হার সাধারণ ফ্লুয়ের চেয়ে দশগুণ বেশি। চীনের অভিজ্ঞতার বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সাময়িকী দা ইকোনমিস্ট বলছে, আক্রান্তদের ৮০ শতাংশের প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা নেই, ১৫ শতাংশের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। আর ৫ শতাংশের অবস্থা হয় গুরুতর, যাদের জন্য নিবিড় পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে। প্রবণতা বলছে, কোনো দেশে এই ভাইরাস একবার ঢুকে পড়লে, তার জনসংখ্যা ২৫ থেকে ৭০ শতাংশ এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভালো নয়। এ ধরনের অচেনা জীবাণুর ভবিষ্যৎ সংক্রমণ ঠেকাতে হলে বিজ্ঞানীরা যেমনটা বলছেন, আগে থেকেই শঙ্কার জায়গাগুলো নিরূপণ করতে হবে। কিন্তু এমন প্রস্তাবে বারবার বাধ সেধেছে, অর্থায়নের বিষয়টি। অথচ সত্য তো এই যে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বিপুল আর্থিক ক্ষতির সামনে দাঁড়িয়ে এখন গোটা বিশ্ব। ব্রিটিশ গণমাধ্যম দা গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এক লাখ কোটি ডলারেরও বেশি আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। অথচ, এ সম্পর্কিত একটি বৈশ্বিক গবেষণা প্রকল্প চালুতে এর চেয়ে ঢের কম অর্থায়নের প্রয়োজন পড়ত। কিন্তু সে পথে হাঁটেননি করপোরেট ও বৈশ্বিক নেতৃবৃন্দ। এখন পর্যন্ত বিশ্বে যেসব রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল, তার একটি বড় অংশের সঙ্গেই মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড জড়িত। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন নতুন পরিবেশের সংস্পর্শে এসেছে মানুষ। আর তা থেকেই একসময় মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন জীবাণু ও তা থেকে সৃষ্ট রোগ। প্লেগ হয়তো মানুষের সংস্কৃতির অংশ ছিল না। কিন্তু মানুষের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিস্তারই প্লেগের জন্মভূমি। একই কথা প্রযোজ্য মধ্যযুগে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়া ‘ব্ল্যাক ডেথের’ ক্ষেত্রেও। প্রাচীন সিল্ক রোড ধরে বাণিজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বিস্তার পেয়েছিল অসংখ্য রোগও। এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল জীবাণু। ইনফ্লুয়েঞ্জার নতুন ধরনটি এসেছিল গবাদিপশুর খামার থেকে। হালের কোভিড-১৯ থেকে শুরু করে ইবোলা, সার্স, মার্স, জিকা—এই সবেরই সংযোগ রয়েছে কোনো না কোনো বন্যপ্রাণীর সঙ্গে। বর্তমানে মানুষ বাস করছে বিশ্বগ্রামে। আগের মতো তাই কোনো একটি রোগ কোনো একটি দেশ বা মহাদেশে আর আবদ্ধ থাকছে না। পণ্যবাণিজ্য বা পর্যটনের মতো নানা সূত্রে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ছে সারা পৃথিবীতে। সময়ের সঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আরও বাড়ছে। বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ঢুকে পড়ছে মানুষ। ফলে সেই প্রাণীদের পক্ষেও আর মানুষের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলা সম্ভব হচ্ছে না। রয়েছে আরেক বিপদ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গলে যাচ্ছে বড় বড় বরফের চাঁই। ফলে নিদ্রা ভাঙছে অচেনা-অজানা অনেক অণুজীবের। নানা দিক থেকেই তাই বিপদ বাড়ছে। কিন্তু নিজেদের বিজয়পতাকায় মুগ্ধ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে সতর্কতা এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রার নয়। নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, ২০১৬ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী ও নাগরিক সংগঠন ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা সম্মিলিতভাবে একটি উদ্যোগ নেয়। মূল লক্ষ্য ছিল সার্স বা মার্সের মতো এখনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি—এমন রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কারে গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করা। সে অনুযায়ী পরের বছর ‘দা কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন’ নামে একটি প্রকল্পও চালু করা হয়। মুশকিল হচ্ছে, এই প্রকল্প মূলত এখন পর্যন্ত জানা কিন্তু মোকাবিলার উপায় না জানা রোগগুলো নিয়েই কাজ করছে। ভবিষ্যতে চোখ রাঙাতে পারে—এমন জীবাণু নিয়ে তারা এখনো তেমন চিন্তিত নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে অজানা শত্রুই সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর। এই শতকের শুরুর দিকে যখন সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) ছড়িয়ে পড়ল, তারপর বাদুড়বাহিত করোনাভাইরাস নিয়ে গবেষণায় একই ধরনের অর্ধশতাধিক ভাইরাস আবিষ্কৃত হলো। এর কোনো কোনোটির দ্বারা মানুষের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই সবগুলোকে মোকাবিলায় সক্ষম এমন প্রতিষেধক তৈরি তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মানুষের হাতে যেসব প্রতিষেধক রয়েছে, তা শুধু নির্দিষ্ট একটি ভাইরাসের বিরুদ্ধেই কার্যকর। অর্থাৎ সার্সের প্রতিষেধক শুধু সার্সের ক্ষেত্রেই কার্যকর, তা কোভিড-১৯ প্রতিহত করবে না। যদিও দুটি ভাইরাসেরই ক্রিয়া পদ্ধতি কাছাকাছি। এ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা একেকটি ভাইরাস পরিবারের সব সদস্যের জন্য কার্যকর এমন প্রতিষেধক তৈরির ওপর জোর দিচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার পাশাপাশি আশু বিপদ মোকাবিলাতেও সবার সতর্ক হওয়াটা তাই সময়ের দাবি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হলো, এ ধরনের পরিস্থিতির শুরুর ধাপেই সবাইকে অবহিত করা ও সতর্ক করা, এবং রোগের বিস্তার ঠেকাতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া। চীন দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নিলেও প্রথমটিতে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনের পরিচয় দিয়েছে। কোভিড-১৯ এর অস্তিত্ব ও এর সংক্রমণের বার্তাটিকে ‘গুজব’ আখ্যা দিয়ে তা গোপন করার চেষ্টা করেছে দেশটির প্রশাসন, যা এর সংক্রমণের পালে হাওয়া দিয়েছে। বিশ্বের অন্য দেশগুলোকে এ থেকে শিক্ষা নিয়েই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আর ভবিষ্যৎ বিপদ ঠেকাতে হলে যে, সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপ ছাড়া গতি নেই, তা তো আগেই বলা হয়েছে।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Scientific Calculator and it's Use | সাইন্টিফিক ক‍্যালকুলেটর ও এর ব্যবহার।

পর্নোগ্রাফির আসক্ত ব‍্যক্তি সম্পর্কে কিছু তত্ত এবং এর থেকে মুক্তির উপায়।

এমপক্স বা মাঙ্কিপক্স ! লক্ষণ ও উপসর্গ ! Monky Pox